শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা ছিল। সুচিন্তিত ও বিজ্ঞানসম্মত এই কর্মসূচিই স্বাধীনতার আদর্শিক ভিত্তি। তর্জনী উঁচিয়ে ৭ মার্চ দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই বাঙালির শক্তি ও সাহসের প্রতীক।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্যারেড গ্রাউন্ডে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বক্তাদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে।
১৮ মার্চের অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল মহাকালের তর্জনী। পুরো আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ‘মুজিব চিরন্তন’।
এ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালভাবে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কম্পোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের বিশাল অর্জন হয়েছে। বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকার ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে।
এ সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন চুক্তি ও তিন দশক ধরে বিরাজমান কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।
জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আলমগীর মোহামদ সিরাজুদ্দীন। এছাড়া মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
অধ্যাপক ড. আলমগীর মোহামদ সিরাজুদ্দীন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তিপ্রয়োগের চেষ্টা করলেই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবেন। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী সামরিক অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
তারপর তিনি পালিয়ে না গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন। পালানোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়নি। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু তিনি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি।
তার কারণ ছিল, আন্তর্জাতিক আইনে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার স্বীকৃতি ছিল না। এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে গণ্য করা হতো। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এ ধরনের রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করত। ইয়াহিয়া খানের কৌশল ছিল বঙ্গবন্ধুকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দিকে ঠেলে দেওয়া। যাতে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের অজুহাতে শক্তিপ্রয়োগের সুযোগ পায়।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই ফাঁদে পান দেননি। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিশ্বজনমত পাকিস্তানকে ধিক্কার দেয়। বাংলাদেশের সমর্থনে তারা এগিয়ে আসে।
আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, মধ্য মার্চে বঙ্গবন্ধু একটি বিদেশি সোর্সকে বলেছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শক্তিপ্রয়োগের চেষ্টা করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সামরিক অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তিনি ঘোষণা করেন। সিরাজুদ্দীন আরও বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই নির্বাচনকে ঐতিহাসিক ৬ দফার পক্ষে গণভোট হিসেবে বিবেচনা করার জন্য।
নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পর পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও একটি সংবিধান রচনার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার আদর্শিক ভিত্তি ছিল ৬ দফা।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলেছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক ইভেন্ট। আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সাধারণ জনগণকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি। গত দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন হয়েছে।
বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্য অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ অনুসরণ করেই এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কম্বোডিয়ার ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একটি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে কম্বোডিয়াও যোগ দিয়েছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। এরপর ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের তিন দশক পার হয়েছে।
এই সময়ে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এবং ফলপ্রসূ সহযোগিতা অব্যাহত। ২০১৪ সালে আমি বাংলাদেশ সফর করেছি। ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা কম্বোডিয়া সফর করেছেন। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য বাড়াতে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়নে উভয় দেশই লাভবান হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্ক এবং করোনা পরিস্থিতিতে একে অন্যের সহযোগিতায় আমরা কাজ করব।
ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, অনুষ্ঠানের মূল উপজীব্য হচ্ছে মহাকালের তর্জনী। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে তর্জনী উঁচিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, আজ সেটিই বাঙালির শক্তি ও সাহসের প্রতীক। জাতির পিতা যখন বলেছিলেন, ‘আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম তখন স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সেই সময়ে একদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু। তাদের ট্যাংক, কামান।
অন্যদিকে নিরস্ত্র বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন অকুতোভয় এক মহানায়ক।