মোটরযান চুক্তি (এমভিএ) পুরো অঞ্চল, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতকে একটি সম্ভাব্য অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তর করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি সই করেন। ওই মাসেই চার দেশীয় মোটরযান চুক্তি সই হয়েছিল। ওই চার দেশের মধ্যে ভুটান এখনো তার পার্লামেন্টে ওই চুক্তি অনুমোদন করাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ওই চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন। ভুটানও পরবর্তী সময়ে পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারে।
জানা গেছে, মোটরযান চলাচল চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ ও ভারত। স্থলসীমান্ত চুক্তি দুই দেশের সীমান্তকে আরো নিরাপদ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে মোটরযান চুক্তিটি একে একটি সম্ভাব্য অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তর করবে।
ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কভিড-১৯ মহামারির পর প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রথম আন্তর্জাতিক সফর হচ্ছে ঢাকায়। এটি নিছক কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে। সেই সঙ্গে উভয় দেশের মধ্যে বছরের নিবিড় সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেরও ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। প্রটোকলগুলো চূড়ান্ত হয়ে গেলে মোটরযান চুক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য নিরবচ্ছিন্ন যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে পারলে ভারতের জাতীয় আয় ৮ শতাংশ এবং বাংলাদেশের জাতীয় আয় ১৭ শতাংশ বাড়তে পারে। বাংলাদেশের পণ্যগুলোর জন্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে একটি বিশাল অব্যবহূত বাজার রয়েছে। সেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে ও কম সময়ে পণ্য পরিবহন সম্ভব। গত মাসে স্বাক্ষরিত মোটরযান চুক্তির রূপরেখা প্রণয়নকারী সাম্প্রতিক সমঝোতা স্মারকটি বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এটি দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা আরো অনেক সহজ করে তুলবে। যেহেতু ভারত থেকে পণ্যবাহী যানবাহনগুলো ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য সীমান্তে অপেক্ষা না করে সরাসরি বাংলাদেশে গন্তব্যে যেতে পারবে, ফলে সীমান্ত বাণিজ্যের সময় এবং ব্যয় উভয়ই কমবে। দুই প্রতিবেশী বিশ্বব্যাপী পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্তের ভাগীদার। দুই দেশের মানুষে মানুষে নিবিড় সম্পর্ক আছে। এর পরও ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্রাজিল বা জার্মানির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করা প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম ব্যয়বহুল।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বর্তমানে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে উভয় দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক সংহত করার ফলে বাণিজ্যের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি ডলারে পৌঁছার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি দুই দেশের শ্রমবাজার এবং সামাজিক খাতের সম্পদগুলোকে আরো সংহত করার একটি সুযোগ উন্মুক্ত করবে। এর ফলে মাথাপিছু আয়, জরুরি ওষুধ সরবরাহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ত্রাণ সহায়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুযোগ বহুগুণে বাড়তে পারে।
ঢাকা ও নয়াদিল্লির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মোটরযান চুক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের মতো ভৌগোলিক নৈকট্য, কূটনৈতিক ঐকমত্য এবং বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কযুক্ত দুটি দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য তাত্পর্যপূর্ণ সুযোগও সৃষ্টি করেছে। মোটরযান চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তা আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে কার্গো এবং যাত্রীবাহী যানবাহনকে ‘প্যাসেজ’ সরবরাহ করবে। এর সফল প্রয়োগ করা হলে সীমান্তে যান চলাচল পরিচালনা করা সহজ হবে। কারণ এর সঙ্গে প্রচুর ‘পেপারওয়ার্ক’ জড়িত এবং যানজট পরিবেশ ও পণ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
একই সঙ্গে পরিবহনের বিভিন্ন পদ্ধতি; যেমন—রেলপথ, বিমানপথ এবং নৌপথ ব্যবহারের ফলে চুক্তিটি সারা দেশে বাণিজ্য সহজ করতে পারে। সংস্কৃতিতে অবিশ্বাস্য রকম সাদৃশ্যপূর্ণ দুটি দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য কল্পনাতীত অর্থনৈতিক একীকরণের সুযোগ রয়েছে।